লিখেছেনঃ অধ্যাপক মোহাম্মাদ হোসাইন ভূঁইয়া (অবসরপ্রাপ্ত)
কলম কালি মন
লিখে তিন জন
সেই কলম নেই সেই কালি নেই লেখার সেই মানসিকতাও নেই। কি লিখব? লেখার বিষয়বস্তু‘ খুঁজে পাইনা। আর লেখার বিষয় খুঁজে পাওয়া গেলেও পাঠক খুঁজে পাওয়া যায়না সেদিন কিছু লোকের কথাবার্তা আড়ি পেতে শুঞ্ছিলাম। লোকেরা সেকালের কলম ও কালি ব্যবহার নিইয়ে মজার মজার আলাপ করছিল। তাদের কথা শুনে আমার ছোটবেলার কলম কালি ব্যবহারের কথা মনে পড়ল।আমি হারিয়ে গেলাম সেই ছোট বেলার পড়ালেখার কর্মকান্ডে ।
১।কঞ্চিকলমঃ কলমের ইতিহাস সভ্যতার ইতিহাসের সমসাময়িক। কলমের ইংরেজি শব্দ “পেন” ল্যাটিন শব্দ “পেন্না” থেকে এসেছে যার অর্থ পাখির পালক। এ থেকে বুঝা যায় এককালে পাখীর পালক কলম হিসাবে ব্যবহৃত হতো। যা হোক, আমার লেখা শুরু হয় বাঁশের কঞ্চির কলম দিয়ে। আমার মা কঞ্চি কলমের সাইজ করে কেটে অগ্রভাগ কলমের নিবের মত চোখা করে কলম বানিয়ে দিতেন। কলম বানাবার জন্য ধারালো চাকু বা ছুরি ব্যবহার করা হতোনা। গৃহস্থ বাড়ির দা বা বঠি দিয়ে কলম বানানো হতো। কঞ্চির কলমের কালি ছিল স্পেসাল। মাটির হাড়ির তলার কালির গুঁড়া ও সিম পাতার রস মিক্সচার করে পরিমাণ মত পানি মিশিয়ে কালি তৈরি হতো। এই কালি মাটির খোড়ায় রেখে কঞ্চির কলমের চোখা অংশ চুবিয়ে তাল পাতায় লিখতাম অ আ ই ঈ ক খ। প্রাচীনকালে কঞ্চির কলমের মতই নলখাগড়ার ডগা দিয়ে কলম তৈরি হতো যা খাগের কলম নামে পরিচিত।খৃষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর পূর্বে মিশরীয়রা খাগের কলম ব্যবহার করত। অতএব, দেখা যায় আমার শিশুকাল প্রাচীন মিশরীয় অবস্থানেই ছিল।
২।হাতলওয়ালা কলম/হ্যান্ডল পেন/নিব কলমঃ স্কুলে ভর্তির পর খাতায় লেখার সুযোগ পাই। তখন ব্যবহার করতাম হাতলওয়ালা কলম বা নিব কলম। হাতলয়াল কলমে ধাতব নিব বসানো থাকত। নিবের অগ্রভাগে ছিল বিন্দুর ন্যায় গোল আর নিবের মাঝ বরাবর চুল পরিমাণ ফাঁক থাকত। নিবের এই ফাঁক যে কালি ধারণ করত তা দিয়ে প্রায় এক মিনিট লেখা যেত। নিবের কালি শেষ হলে কলমটি আবার কালিতে চুবানো হতো। কলমের নিবের স্থায়িত্ব বেশি ছিলনা। কিছুদিন লেখার পরই নিব নষ্ট হয়ে যেত। তবে হাতলে নিব লাগানো যেত। দুই পয়সা দিয়ে দোকান থেকে নিব কেনা যেত। এবং হাতলে নিব লাগিয়ে আবার আমরা কলম চালু করতাম। মিশরীয়রা সর্ব প্রথম কাঠির ডগায় তামার তৈরি নিব লাগিয়ে হ্যান্ডল পেন বা হাতলওয়ালা কলম তৈরি করে।
হতলওয়ালা কলমের জন্য আমরা দোয়াতের কালি ব্যবহার করতাম। কালি রাখার জন্য দোয়াত কিনতে পাওয়া যেত। দুই পয়সা করে দোকানে কালির ট্যাবলেট পাওয়া যেত। দোয়াতে পানি ভরে কালির ট্যাবলেট পানিতে ছেড়ে দিলে রাতারাতি গলে যেত এবং লেখার জন্য কালি প্রস্তুত হতো। লেখা উজ্জল হওয়ার জন্য অনেক সময় আমরা কালিতে কাঁচা হরিতকীর রস মিক্সচার করতাম। পরীক্ষার সময় আমরা কালির দোয়াত এবং হাতলওয়ালা কলম নিয়ে স্কুলে যেতাম। হাত থেকে বা বেঞ্চ থেকে প্রায়ই দোয়াত পড়ে যেত আর তাতে আমাদের জামা কাপড়ে কালির দাগ পড়ত। কলম কালিতে চুবিয়ে মাঝে মাঝে ঝাড়া দিতাম। তখন নিজের গায়ে অথবা অন্যের গায়ে কালির ছিটা লাগত।
৩। মধ্যযুগে কাগজ আবিষ্কারের পর পাখির পালকের কলম ব্যবহার শুরু হয়। রাজহাঁস, ময়ূর এবং আরো অনেক পাখির পালক দ্বারা কলম তৈরি হতো। পাখির পালকের কলমকে কুইল কলমও বলা হয়। আর দোয়াতের কালি ব্যবহার করেই কুইল কলম দিয়ে লেখা হতো। এই কলম ব্যবহার করত জমিদার শ্রেণির লোকেরা। আমাদের কালে এই কলমের দেখা পাইনি। তবে গল্প শুনেছি প্রচুর।
৪। প্রায় চার হজার বছর আগে গ্রীসবাসীরা স্টাইলাস (Stylus) কলম ব্যবহার করত। স্টাইলাস কলম তৈরি হতো হাতির দাঁত থেকে। এই কলমের নাম আমরা শুনিনি। আর আমাদের দেশে এর ব্যবহার হয়েছে কিনা তাও জানা নেই।
৫। ঝরনা কলম বা ফাউন্টেন পেনঃ এই কলমের ইতিহাস অনেক লম্বা। প্রথমে মিশরে ৯৫৩ সালে ফাওউন্টেন পেন আবিষ্কার হয়। এর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কলম আবিষ্কারের প্রচেষ্টা চলতে থাকে। খুব সম্ভব ওয়াটারম্যান ১৭৮০ সালের দিকে এই কলম ইংল্যান্ডে আবিষ্কার করেন। এর পর বিভিন্ন সময়ে ফাউন্টেন পেনের অনেক মডিফিকেশন হয়। এর নিব তৈরি হতো দামি ধাতব পদার্থ দিয়ে। আর নিবের ডগা তৈরি হতো ইউরোনিয়াম দিয়ে। ঝরনা কলমকে আমরা ফাউন্টেন পেন হিসাবেই জানি। অনেক নামী দামি ফাউন্টেন পেন ছিল। যেমন, পার্কার, পাইল্ট, স্যামসাং, ইয়থ ইত্যাদি নামের দামি কলম ছিল। আবার কম দামের কলমও ছিল। আমি ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে ওঠার পর আমাকে কম দামের একটি ফাউন্টেন পেন কিনে দেওয়া হয়। সেকালে গুলিস্তান এলাকায় অনেক কলম মেকার বসত। তাদের নিকট থেকে সস্তায় কলম পাওয়া যেত। এই কলমে কালি ভরার রিজারভিয়র বা প্রকোষ্ঠ ছিল। প্রকোষ্ঠের সাথে একটি সরু পথ ছিল যা কলমের নিবের সাথে সংযুক্ত। মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে রিজারভিয়র হতে কালি নিবে যেত এবং আমরা খাতায় বা কাগজে লিখতে পারতাম। ড্রপার বা সিরিঞ্জ দিয়ে আমরা কলমে কালি ভরতাম। নিব নষ্ট হয়ে গেলে বদলাবার ব্যবস্থা ছিল। এই কলমের সুবিধা হচ্ছে একবার কালি ভরলে তিন ঘণ্টার পরীক্ষা অনায়াসে দেওয়া যেত। সাবধানতা এড়ানোর জন্য পরের দিনের পরীক্ষার জন্য কালি ভব্রে নিতাম। আমি অনেক রকমের ফাউন্টেন পেন দেখেছি এবং ব্যবহার করেছি। পাইলট, পার্কার, ইয়থ ইত্যাদি নামের ফাউন্টেন পেনের কথা মনে পড়ছে।
সেকালে অনেক ব্র্যান্ডের কালি ছিল। যেমেন, পেলিকান, অস্ট্রিচ, ইয়থ ইত্যাদি। কালির মধ্যে ছিল কালো অথবা রয়েল ব্লু।
৬। বলপয়েন্ট কলমঃ বলপয়েন্ট কলমকে রিফিল কলমও বলা হয়। বলপয়েন্ট কলম আবিষ্কারের ইতিহাস দীর্ঘ হলেও সর্ব সাধারণের ব্যবহারের জন্য বাজারে আসে ১৯৬০’র দশকে। আমাদের দেশে আসে আরো অনেক পরে। খুব সম্ভব আশির দশকের শুরুতে অথবা সত্তুর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। এসময়ে কত মানুষ বিদেশ যেত এবং পকেটে করে তারা কলম নিয়ে আসত ও প্রিয় জনরে উপহার দিত। ১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম আমেরিকার নাগরিক জন জে লাউড বলপয়েন্ট পেন আবিষ্কার করেন। জন লাউডের এই কলম খুব সহজলভ্য ছিলনা। গত শতাব্দীর তৃতীয় দশকে হাঙ্গেরিয়ান নিউজ পেপার এডিটর লাসলো বিরো ও তার ভাই জন বিরো নতুন ধরনের বলপয়েন্ট পেন আবিষ্কার করেন। এই কলমের বৈশিষ্ট্য হল কলমের ফাঁপা স্থানে খুব ঘন কালি স্থাপন করা হয়। কলমের অগ্রভাগে নিব তুল্য স্টিলের বা পিতলের বল লাগানো থাকে যা দ্বারা আমরা লিখে। ফাউণ্টেন পেনের মতই মাধ্যাকর্ষণজনিত প্রভাবে বলে কালি প্রবেশ করে এবং আমরা লিখতে পারি।
বর্তমানে বলপয়েন্ট খুবই জনপ্রিয়। এক রিফিল শেষ হলে আর এক রিফিল ভরা যায়। বর্তমানে অবশ্য কেউ আর রিফিল ভরেনা। বলপয়েন্ট কলম এত সস্তা যে কালি শেষ হলে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া হয় আবার নতুন একটা ক্রয় করা হয়। আমি ১৯৮২ সালে সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা বলপয়েন্ট কলম গিফট পেয়েছিলাম। কলমের মধ্যে একটি ঘড়িও ছিল। এই দামি কলম দিয়ে আমি কখনো লিখিনি। শুধু দেখতাম। একদিন দেখলাম কালি শুকিয়ে গেছে ঘড়িও স্পন্দনহীন হয়ে পড়েছে।
বলপয়েন্টে এখন যেমন ঘড়ি আছে অদূর ভবিষ্যতে এই কলমে টেলিফোন বা মোবাইলের ব্যস্থাও থাকতে পারে। অথবা এখনই তা আছে যা আমি জানিনা।