ফক্রেঃ আমাদের ইসলাম |
হাজার বছরের
ঐতিহ্যে লালিত এই বাংলা। নদীমাতৃক একটি অঞ্চল। মাটির উর্বরতা, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য
আর ঋতুবৈচিত্র্যের কারণেই খ্রিস্টপূর্ব সময়।থেকেই এ অঞ্চলের প্রচুর সম্ভাবনা
ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বময়। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে এ অঞ্চলে যখন যে গোষ্ঠীর আগমন ঘটেছে ও বসতি স্থাপিত হয়েছে তাদের
প্রত্যেকেই মাটিঘেঁষা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হয়েছে। জনবসতির প্রথম শর্তই হচ্ছে
জীবিকা।
বলা যায়, সমতলে
ধান চাষের প্রথম প্রবর্তক হচ্ছে অষ্ট্রিক গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর আরেক নাম ছিল নিষাদ। এই জনগোষ্ঠীর পর এ অঞ্চলে আগমন ঘটে আলপাইন বা অনার্য জনগোষ্ঠীর। বর্তমান বাঙালি সমাজে আমাদের মধ্যে এদের
বংশধরই বেশি। এরপর আসে আর্যরা। সেটি খ্রিস্ট্রীয় পঞ্চম শতকের কথা। মূলত অনার্যদের
কৃষি, সংস্কৃতি ও ভাষায় আকৃষ্ট হতে থাকে তারা। আর্যদের আগে অনার্য ও তামিলরা এ
দেশে প্রথম নারকেল, সুপারি ও নানারকম ফলবান বৃক্ষের চাষ ও সবুজ বাগিচা বানানোর রীতি প্রবর্তন করেন।
এর পরে বাংলায় যত
বিদেশি গোষ্ঠী এসেছে, উপনিবেশ গড়েছে এরা নানা ক্ষেত্রে
অবদান রাখলেও কৃষি ক্ষেত্রে তেমন অবদান রাখেনি। আরব, পারস্য, মােগল, পাঠান, ইংরেজ,
ফরাসি সবাই শহুরে জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তবে ব্যতিক্রম ছিল পর্তুগিজরা। তারা এ
দেশে আলু, পেঁপে, আনারস, কামরাঙা, পেয়ারা, কৃষ্ণচূড়া ফুল ও তামাক আবাদ শুরু করে।
সম্রাট আকবরের সময়
মূলত শুরু হয় বাংলা সন তারিখ গণনার কাজ। সেখানেও ছিল কৃষিরই প্রাধান্য। ছিল
হালখাতা ও বর্ষবরণ প্রবর্তনের বিষয়-আশয়। মূলত ঋতু ও মাসভিত্তিক বাঙালি সংস্কৃতির এক অভিযাত্রা ঘটে সে সময়ই। নতুন
বিন্যস্ত বাংলা সন ফসলি সন হিসেবেও আখ্যা পায়। সে সময় থেকেই মূলত সমৃদ্ধ হতে
থাকে আমাদের বাংলা সংস্কৃতি। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাঙালি সংস্কৃতির
শিকড়ই হচ্ছে লােকসংস্কৃতি। আর লােকসংস্কৃতির গােড়াপত্তনই ঘটে মানুষের।
জীবন-জীবিকা অর্থাৎ কৃষির ওপর ভিত্তি করে।
দেখা যায়,
গম্ভীরা, গাঁথা, গীতিকা, ছড়া, জারিগান, ঝুমুর, ডাক ও খনার বচন, বাউল গান, ধাঁধা,
প্রবাদ, প্রবচন, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, রূপকথা, সারিগান প্রভৃতি লােকসংস্কৃতি
উপাদানের মধ্যে রয়েছে কৃষিতথ্য। একই ভাবে গ্রামীণ সংস্কৃতির মূল প্রাণশক্তি
হিসেবে ভূমিকা রেখেছে বাংলা বর্ষবরণ, গ্রাম্য মেলা ও কৃষিমেলা; যার মধ্য দিয়ে
বাঙালির আদি জীবনব্যবস্থা, বিনোদন এবং মনের ভাব
প্রকাশের এক বড় ক্ষেত্র তৈরি হয়। বিভিন্ন উৎসব আয়ােজনে এসেছে যাত্রাপালা,
জারিগান, পালাকাব্য প্রভৃতি উপাদান। আর এসব উপাদানে স্থান পেয়েছে ফসল কাটার গান,
ভূমি জোরদখলের প্রতিবাদে পালাগান, কবিগান ইত্যাদি। আর ভাওয়াইয়া-ভাটিয়ালিতে তো কৃষির প্রভাব ছিলই।
নৃবিজ্ঞানে ভাষাকে
সংস্কৃতির মূল সংরক্ষণাধার বলা হয়। এ ছাড়া সংস্কৃতির অন্য উপাদানগুলো হচ্ছে খাদ্যাভ্যাস, আত্মীয় সম্পর্ক এবং
অতিপ্রাকৃতের ধারণা ও বিশ্বাস। ধর্ম, গোত্র যা-ই থাক ভাষা,
অভিন্ন জৈব পরিবেশ ও জীবন-জীবিকাই পৃথিবীর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে বাংলাকে আলাদা করেছে। একই সমাজ ও উৎপাদনব্যবস্থায় অংশ
নিয়ে হাজার বছর ধরে মাটি আর বাঁশ-খড়ের তৈরি ঘরে বাংলার জনগোষ্ঠী বসবাস করে এসেছে। ত্যিই মাটিঘেঁষা এক সংস্কৃতির দাবিদার এই বাংলা।
১৯৪৭-এ ভারত
বিভক্তির অনেক আগেই পূর্ববঙ্গে অবস্থানরত বাঙালিদের জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতি
একটি স্বতন্ত্র পরিচয়ে জাগ্রত হয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমল শুরুর সময়ই তৎকালীন
কেন্দ্রীয় সরকারের। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পাঁয়তারার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে
থাকে বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, সর্বস্তরের পেশাজীবী থেকে শুরু করে কৃষক পর্যন্ত। এরই
চূড়ান্ত রূপ '৫২-এর ভাষা আন্দোলন। বাঙালির ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে
স্বাধীনতার যে। বীজ বপিত হয়েছিল তারও চূড়ান্ত রূপ পায় ১৯৭১ এ।
স্বাধীন বাংলাদেশ, মোটা ভাত মোটা কাপড়ের জন্য
সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার খেটে খাওয়া কৃষক মজুর থেকে শুরু করে সর্বস্তরের
মানুষ। আমাদের। সবচেয়ে গর্বের সেই ইতিহাস সবারই জানা। '৭১ এ ২০০ বছর পর নতুন
বাংলাদেশে উদিত হয় স্বাধীন সূর্য। নিজস্ব দেশ, নিজস্ব ভূমি, নিজস্ব ভাষা
সংস্কৃতির অহংকার নতুন এক দিগন্তে স্বপ্নে উজ্জীবিত করে প্রতিটি মানুষকে। এই যে
বাঙালির দীর্ঘ অভিযাত্রা ও পথচলা এর মধ্যে পুরো অংশ। জুড়ে ছিল
কৃষিরই প্রাধান্য। ছিল উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার
নতুন স্বপ্ন। আমরা মায়ের ভাষার। অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছি, স্বাধীন সার্বভৌম
রাষ্ট্র । পেয়েছি তাই নিজ দেশে ফসল ফলিয়ে স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসেও
আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছি।
এটি অনেক বড়
অর্জন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সবচেয়ে গর্বের বিষয়। আমাদের ভাষাশহীদ দিবসও
পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা।সব মিলিয়েই কৃষিসংস্কৃতিতে লালিত বাঙালি
তার অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠায় সর্বদা সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। এবং জয়লাভ করেছে। বাংলা
ভাষা আমাদের কৃষকের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতির মূল শিকড় হচ্ছে। বাংলা। বাঙলির এই অহংকার
আজ বিশ্বব্যাপী।
Acknowledgment: Addunik Krishi Khamar
No comments:
Post a Comment
Thanks for commenting